এসি ছাড়া ঘর ঠান্ডা রাখার ১২ টি উপায়

এসি ছাড়া ঘর ঠান্ডা রাখার ১২ টি উপায়

আজকের এই অগ্নিগর্ভ গরমে জিজ্ঞেস করুন ঢাকার যেকোনো বাসিন্দাকে – সবচেয়ে বড় সমস্যা কি? নিঃসন্দেহে উত্তর আসবে “প্রচণ্ড গরম”। গ্রীষ্মকালের উত্তাপ যেন আমাদের জীবনেরই অংশ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের গ্রীষ্মকাল যেন প্রতিবছর আরও নিষ্ঠুর রূপ ধারণ করছে। ঢাকা থেকে খুলনা, যশোর থেকে চুয়াডাঙ্গা, সব জায়গাতেই তাপমাত্রার পারদ উত্তাপে চড়াই করছে।

অনেকেই গরম থেকে বাঁচার জন্য এসি ব্যবহার করেন। একদিকে বিদ্যুৎ বিল, অন্যদিকে এসির দাম- দুটোই আকাশচুম্বী। অনেকের জন্যই এসি কেনা আর চালানো দুটোই বাজেটের বাইরের বিষয়। আবার অনেকে আছেন যারা শারীরিক সমস্যার কারণে এসির বাতাস সহ্য করতে পারেন না।

তাঁদের জন্য স্বস্তির কোনো উপায় নেই? অবশ্যই আছে! প্রকৃতি এবং বিজ্ঞান মিলিয়ে এমন অনেক সমাধান দিয়েছে যার সাহায্যে এসি ছাড়াই আপনার ঘরকে অনেকটাই ঠান্ডা রাখা সম্ভব।

তো চলুন জেনে নেওয়া যাক এসি ছাড়া ঘর ঠান্ডা রাখার ১২টি কার্যকরী উপায়। এসব উপায় অবলম্বন করে আপনিও গরমের মৌসুমে স্বস্তি পেতে পারেন এবং বিদ্যুৎ বিলও বাঁচাতে পারেন।

এসি ছাড়া ঘর ঠান্ডা রাখার ১২ টি উপায়

গরমকালে ঘর ঠান্ডা রাখা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু কিছু সহজ কৌশল অবলম্বন করলেই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যায়। নিচে তেমনই ১২টি কার্যকরী উপায় নিয়ে আলোচনা করা হলো।

১. ব্ল্যাকআউট কার্টেন ও পর্দা ব্যবহার করুন

গরমের সময় সূর্যের তাপ সরাসরি ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে ঘরকে উত্তপ্ত করে তোলে। ব্ল্যাকআউট কার্টেন বা মোটা পর্দা ব্যবহার করলে দিনের বেলায় সূর্যের তাপ ঘরে ঢুকতে বাধা পায়। ফলে ঘরের ভেতরের তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে কম থাকে। বিশেষ করে পশ্চিম দিকের জানালাগুলোতে এই ধরনের পর্দা ব্যবহার করা খুব জরুরি। চেষ্টা করবেন হালকা রঙের পর্দা ব্যবহার করতে, কারণ হালকা রং তাপ প্রতিফলিত করে।

২. জানালায় সান শেড বা অ্যাওনিং বসান

জানালার উপরে সান শেড বা অ্যাওনিং লাগালে সরাসরি সূর্যের আলো কাঁচ ভেদ করে ঘরে ঢুকতে পারে না। এটি অনেকটা ছাদের মতো কাজ করে, যা দেয়ালের এবং জানালার উপর সরাসরি রোদ পড়া থেকে আটকায়। ফলে ঘর অনেক ঠান্ডা থাকে। যাদের বারান্দা আছে, তারা বারান্দার রেলিং-এ লতানো গাছ লাগিয়েও প্রাকৃতিক সান শেডের মতো তৈরি করতে পারেন।

৩. ঘরের বাইরের দেয়ালে হিট-প্রোটেক্টিভ পেইন্ট

বর্তমানে বাজারে UV resistant এবং Heat reflective পেইন্ট পাওয়া যায়। এই বিশেষ ধরনের রং বাইরের তাপ শোষণ করে না, বরং প্রতিফলিত করে দেয়। ফলে ঘরের ভেতরের তাপমাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। যদিও এটি একটু ব্যয়বহুল, তবে দীর্ঘমেয়াদী আরামের জন্য এটি একটি ভালো উপায় হতে পারে।

৪. সিলিং ও দেয়ালে তাপরোধক বোর্ড ব্যবহার করুন

বর্তমানে হিট ইনসুলেশন বোর্ড পাওয়া যাচ্ছে যেগুলো সিলিং ও দেয়ালে লাগালে বাইরের গরম ভেতরে ঢুকতে পারে না। সাধারণত ফোম বোর্ড বা জিপসাম ইনসুলেটেড বোর্ড ব্যবহৃত হয়। যারা ঘর বানাচ্ছেন বা রিনোভেট করছেন, তারা অবশ্যই ইনসুলেশন বিবেচনায় রাখতে পারেন।

৫. ছাদে রিফ্লেক্টিভ কোটিং দিন

গরমকালে ছাদ সবচেয়ে বেশি উত্তপ্ত হয় এবং সেই তাপ ধীরে ধীরে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে। ছাদে রিফ্লেক্টিভ কোটিং (যেমন – সাদা চুন বা বিশেষ ধরনের সাদা রং) ব্যবহার করলে সূর্যের তাপ প্রতিফলিত হয়ে যায়। এর ফলে ছাদ কম গরম হয় এবং আপনার ঘরও ঠান্ডা থাকে।

৬. বাড়ির চারপাশে গাছ লাগিয়ে প্রাকৃতিক ছায়া তৈরি

প্রকৃতি আমাদের সবচেয়ে বড় এয়ার কন্ডিশনার। বাড়ির চারপাশে বড় গাছ লাগালে তা সূর্যের আলো থেকে ছায়া দেয় এবং বাতাসকে ঠান্ডা রাখে। বিশেষ করে পশ্চিম দিকে বড় গাছ থাকলে বিকেলের প্রখর সূর্যের তাপ থেকে বাড়িকে রক্ষা করে।

গবেষণায় দেখা গেছে, সঠিকভাবে বাড়ির চারপাশে গাছ লাগালে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণে বিদ্যুৎ খরচ ২৫-৪০% পর্যন্ত কমানো সম্ভব। ভাবুন, এসি চালানোর খরচ এবং পরিবেশের উপকার, দুটোই একসাথে পাওয়া যাইয় কিছু গাছ লাগিয়ে!

৭. এক্সজস্ট ফ্যান ব্যবহার করে গরম বাতাস বের করে দিন

ঘরের উপরের অংশে এক্সজস্ট ফ্যান বসিয়ে ঘরের গরম বাতাস বাইরে বের করে দেওয়া এসি ছাড়া ঘর ঠান্ডা রাখার একটি কার্যকরী উপায়। কারণ গরম বাতাস হালকা হওয়ায় সর্বদা উপরে থাকে। এক্সজস্ট ফ্যান এই গরম বাতাস বের করে দিলে নিচের দিক থেকে তুলনামূলক ঠান্ডা বাতাস প্রবেশ করে।

সবচেয়ে ভালো ফলাফল পেতে, একটি ঘরের নিচের দিকে জানালা খোলা রেখে উপরের দিকে এক্সজস্ট ফ্যান চালানো সহায়ক। এতে একটি প্রাকৃতিক বাতাস প্রবাহ তৈরি হয়, যা ঘরের তাপমাত্রা দ্রুত কমাতে সাহায্য করে।

৮. পানির সাহায্যে ঠান্ডা ভাব তৈরি করুন

ভেজা কাপড় বা তোয়ালে ঘরের মধ্যে ঝুলিয়ে রাখলে তা বাষ্পীভূত হওয়ার সময় ঘরকে ঠান্ডা করে। এছাড়াও, স্প্রে বোতলে জল ভরে মাঝে মাঝে ঘরের চারপাশে স্প্রে করলে evaporative cooling এর মাধ্যমে ঘর ঠান্ডা থাকে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, বাতাসে যেন খুব বেশি আর্দ্রতা না থাকে। এছাড়া ছাদে পানি ছড়িয়ে দিয়েও ঘরকে ঠান্ডা করা যায়।

৯. দিনের বেলা অপ্রয়োজনীয় লাইট বন্ধ রাখুন

ইলেকট্রিক লাইট থেকে তাপ উৎপন্ন হয়, বিশেষ করে ইনসেনডেসেন্ট বাল্ব (পুরাতন ধরনের হলুদ আলো)। দিনে এই লাইট জ্বালানোর প্রয়োজন নেই। চেষ্টা করুন LED বাল্ব ব্যবহার করতে, যেগুলো কম বিদ্যুৎ খায় এবং তাপও কম সৃষ্টি করে। অপ্রয়োজনীয় লাইট বন্ধ রাখলে ঘর কিছুটা হলেও ঠান্ডা থাকে।

১০. রান্নার সময় দরজা-জানালা খুলে দিন

রান্নার সময় তৈরি হওয়া তাপ ঘরে আটকে থাকলে পুরো বাসার তাপমাত্রাই বেড়ে যায়। এজন্য রান্নাঘরের দরজা-জানালা খোলা রাখুন যাতে গরম বাতাস বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে।

এছাড়া যদি সম্ভব হয়, দুপুরের গরম সময়ে চুলা ব্যবহার না করে সকাল বা সন্ধ্যায় রান্না করা ভালো। সকালের দিকে রান্না করে রাখলে সারাদিনের তাপমাত্রা কম থাকবে।

১১. গৃহসজ্জা হালকা ও হাওয়াবান্ধব রাখুন

ঘরে ভারী কার্পেট, মোটা সোফা, হেভি কভারযুক্ত বিছানাপত্র থাকলে তা তাপ শোষণ করে রাখে। এর পরিবর্তে হালকা রঙের সুতির পর্দা, বেডশিট ও অন্যান্য জিনিস ব্যবহার করুন। হালকা রঙ তাপ প্রতিফলিত করে এবং ঘরকে হালকা রাখে। যত সম্ভব কম আসবাব রাখুন। ঘর খোলামেলা থাকলে বাতাস চলাচল ভালো হয়।

১২. বিকেলের পরে জানালা খুলে ঠান্ডা বাতাস ঢুকতে দিন

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলে বাইরের বাতাস তুলনামূলকভাবে ঠান্ডা হতে শুরু করে। তখন ঘরের সব জানালা খুলে দিন, যেন ঠান্ডা হাওয়া সহজে ঘরে ঢুকতে পারে। একটি ঘর থেকে আরেক ঘরের দিকে বাতাস প্রবাহিত করতে দুই পাশের দরজা/জানালা খুলে ক্রস ভেন্টিলেশন তৈরি করুন।

শেষ কথা

বাংলাদেশের প্রচণ্ড গরমে এসি ছাড়া ঘর ঠান্ডা রাখার উপায় খুঁজছেন? উপরের এই ১২টি পদ্ধতি অবলম্বন করে আপনি অবশ্যই কিছুটা স্বস্তি পেতে পারেন। মনে রাখবেন, কোনো একটি পদ্ধতি একা কাজ না করতে পারে। এগুলো একসাথে প্রয়োগ করলেই সর্বোত্তম ফল পাওয়া যাবে।

বিদ্যুৎ বিল বাঁচানো, পরিবেশ রক্ষা করা এবং নিজের স্বাস্থ্য ভালো রাখা- এই তিনটি উদ্দেশ্য একসাথে পূরণ হয় এসি ছাড়া প্রাকৃতিক উপায়ে ঘর ঠান্ডা রাখার মাধ্যমে।

FAQs

১. শুধু ফ্যান দিয়েই কি ঘর ঠান্ডা রাখা সম্ভব?

শুধু ফ্যান ব্যবহার করে সরাসরি ঘরের তাপমাত্রা কমানো যায় না। ফ্যান মূলত আমাদের শরীরের ঘামকে বাষ্পীভূত করার মাধ্যমে ঠান্ডা অনুভব করায়। যখন বাতাস চলাচল করে, তখন আমাদের ত্বকের আর্দ্রতা দ্রুত শুকিয়ে যায়, ফলে আমরা ঠান্ডা বোধ করি।

তবে, যদি ঘরের বাতাস অলরেডি গরম থাকে, তাহলে ফ্যান সেই গরম বাতাসই চারপাশে ঘোরাতে থাকে। তাই, ফ্যানের সাথে অন্যান্য পদ্ধতি (যেমনঃ জানালা খোলা রাখা, ভেজা কাপড় ব্যবহার করা) অবলম্বন করলে ঘরকে তুলনামূলকভাবে ঠান্ডা রাখা সম্ভব।

২. গাছপালা কতটা কার্যকর?

গাছপালা ঘর ঠান্ডা রাখার ক্ষেত্রে বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখে। গাছ প্রাকৃতিক ছায়া তৈরি করে, যা সরাসরি সূর্যের তাপ ঘরে প্রবেশ করতে বাধা দেয়। এছাড়াও, গাছের পাতা প্রস্বেদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জলীয় বাষ্প বাতাসে ছাড়ে, যা পরিবেশকে কিছুটা ঠান্ডা করে। বাড়ির চারপাশে এবং বারান্দায় গাছ লাগালে তা ঘরের তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে। তবে একটি-দুটি গাছের চেয়ে বেশি সংখ্যক গাছ লাগালে এর প্রভাব ভালোভাবে বোঝা যায়।

৩. ছাদে গাছ রাখলে কি তাপ কমে?

হ্যাঁ, ছাদে গাছ বা ছাদকৃষি করলে ঘরের তাপমাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। মাটি ও গাছ ছাদের উপর একটি প্রাকৃতিক তাপরোধক স্তর তৈরি করে, যা সরাসরি রোদের তাপ ঘরে ঢুকতে বাধা দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ছাদে গাছ থাকলে ঘরের তাপমাত্রা ৩-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কম হতে পারে। তবে ছাদে গাছ রাখার সময় পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা এবং ছাদ সুরক্ষার বিষয়টি অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে।