সভ্যতার শুরু থেকেই প্রাণীকুলকে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যে জিনিসটি অবদান রাখছে তা হলো গাছ। গাছ ছাড়া যেখানে প্রাণের অস্তিত্ব কল্পনা করাই অসম্ভব, সেখানে বিবর্তন তো বহুদূরের বিষয়।
গ্রামে গাছগাছালির কাছাকাছি থাকা হলেও শহরে সেই সুযোগটা খুবই কম। তবে অনেকে শহরে থেকেও বাড়ির ছাদে, বেলকনিতে কিংবা নিজের শোবার ঘরেও নানা প্রজাতির গাছ লাগানোর চেষ্টা করছে।
আজকের আর্টিকেলে ইন্ডোর প্ল্যান্ড কি, ইন্ডোর প্ল্যান্টের নাম, ইন্ডোর প্ল্যান্টের যত্ন ও পরিচর্যা সম্পর্কে বিস্তারিত জানাবো। অর্থাৎ ইন্ডোর প্ল্যান্টের যত কথা আছে সবকিছু জানানোর একটা ছোট্ট প্রচেষ্টা থাকবে।
Contents
আমরা ইন্ডোর প্ল্যান্ট বলতে মূলত সেই গাছগুলোকে বুঝি যেগুলো আকারে ছোট ও গোছালো, ঘরের মধ্যে অল্প আলোতে বেড়ে উঠবে এবং ঘরের অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবে।
এই গাছগুলোকে কখনো কখনো হাউজ প্ল্যান্ট, অর্নামেন্টাল প্ল্যান্ট কিংবা পট প্ল্যান্ট-ও বলা হয়ে থাকে। বেশিরভাগ ইন্ডোর প্ল্যান্টের সর্বোচ্চ উচ্চতা ১.৫ থেকে ২ ফুটের মধ্যে হয়ে থাকে।
আমরা যারা শহরে থাকি তারা কখনো না কখনো বিশুদ্ধ বাতাসের তীব্র অভাব অনুভব করেছি। বিশেষ করে যারা ঢাকার মতো জনবহুল ও দূষিত বায়ুর শহরে থাকি তারা অবশ্যই এটা খেয়াল করেছি।
বায়ু দূষণ বলতে আমরা অনেকেই মনে করি শুধু বাসার বাইরের কলকারখানা, যানবাহন থেকে নিঃসৃত ধোয়া কিংবা বাইরের ধুলাবালি। ধারণাটি আংশিক সত্য হলেও সম্পূর্ণ সত্য নয়।
অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড ও অপর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাবেও বায়ু ভীষনভাবে দূষিত হয়। এটা ঘটে আমাদের আবদ্ধ বাসা-বাড়ির ক্ষেত্রে। সেখানে মূলত কার্বন ডাই অক্সাইড থাকলেও অক্সিজেনের অভাব থাকে। যেটা আমরা স্বাভাবিক দৃষ্টিতে বুঝতেও পারি না।
আর্টিকেলের এই অংশে আমরা ইন্ডোর প্ল্যান্টের উপকারিতা নিয়ে কথা বলবো। যদিও এর বহুবিধ উপকারিতা ও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তবে আমরা সবগুলো বিষয়ে নিয়ে আলোচনা করবো না। মূলত সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে আপনাকে জানানোর চেষ্টা করবো। ইন্ডোর প্ল্যান্টের উপকারিতাসমূহ নিম্নরূপ-
ইন্ডোর প্ল্যান্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এটি ঘরের মধ্যকার বাতাসকে বিশুদ্ধ ও ঠান্ডা রাখতে বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখে।
নাসার এক গবেষণায় জানা গেছে, ইন্ডোর প্ল্যান্ট কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইডের মতো ক্ষতিকর পদার্থ শোষণ করে নেয় এবং বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়ায়।
আপনার ঘরে যদি কিছু সুস্থ্য গাছ থাকে তাহলে আপনি এটা ধরেই নিতে পারেন যে নির্মল বাতাস গ্রহণ করছেন।
আমরা সকলেই যে বিষয়টার জন্য ইন্ডোর প্ল্যান্ট রাখতে চাই তা হলো এটি ঘরের সৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। এজন্য এটাকে অনেকেই অর্নামেন্টাল প্ল্যান্ট নামেও ডাকে।
বিভিন্ন আকৃতি ও রঙের ইন্ডোর প্ল্যান্ট রয়েছে যেগুলো ঘরের সৌন্দর্যে নতুন মাত্রা যোগ করে। দেয়ালে, পড়ার টেবিলে কিংবা শেলফের এক কোনায় কয়েকটি ইন্ডোর প্ল্যান্ট রেখে দিলে তা অবশ্যই মন্দ দেখায় না।
আমরা প্রযুক্তির এই সময়ে এসে অনেক বেশি স্মার্ট ডিভাইস কেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছি এবং অবসর সময় পেলেই সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করে কাটিয়ে দেই।
এতে প্রকৃতির সাথে আমাদের সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে না, নিজেকে সময় দেওয়া হচ্ছে না। ফলে বাড়ছে মানসিক চাপ, মাথাব্যথাসহ নানা শারিরীক ও মানসিক অসুস্থতা।
কেউ যদি ঘরে কিছু ইন্ডোর প্ল্যান্ট লাগায়, বাড়ির ছাদে কিংবা বেলকনিতে কিছু গাছগাছালি রাখে সেগুলো তাকে যেমন আনন্দ দিবে তেমনি অবসর সময়ে সেগুলোর যত্ন নিলে আমরা স্মার্ট ডিভাইস, সোশ্যাল মিডিয়া থেকেও নিজেকে দূরে রাখতে পারবো। এতে আমাদের মানসিক চাপ কমবে, শরীর ও মন দুটোই সুস্থ্য থাকবে।
তাই এখানকার তরুণ-তরুণীদের এ বিষয়ে ভাবা উচিত। স্মার্ট ডিভাইস ও সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহার কমিয়ে প্রকৃতির সাথেও সুসম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত।
তুলসি কিংবা অ্যালোভেরা এর মতো অনেক ঔষধি গাছ রয়েছে যেগুলোকে সঠিক যত্ন ও পরিচর্যার মাধ্যমে খুব সহজেই আমরা ঘরের ভেতরে এদের বৃদ্ধি ঘটাতে পারি। প্রয়োজনের মুহূর্তে এসব গাছের পাতা, ডগা বেশ কাজে লাগে।
সারা বিশ্বে কয়েক হাজারের বেশি ইন্ডোর প্ল্যান্ট রয়েছে। এগুলোর সব আমাদের দেশের আবহাওয়াতে সঠিকভাবে বেড়ে ওঠে না এবং একজনের পক্ষে সব ইন্ডোর প্ল্যান্ট সংগ্রহ করাও সম্ভব হয় না।
তাই আপনাদেরকে এমন কিছু উপকারী ইন্ডোর প্ল্যান্টের নাম জানাবো যেগুলো বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার জলবায়ু ও আবহাওয়াতে খুব ভালোভাবে বেড়ে ওঠে।
আমাদের দেশে ইন্ডোর প্ল্যান্টের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত হচ্ছে ফিলোডেনড্রন, যেটাকে আমাদের বেশিরভাগই মানিপ্ল্যান্ট বা পথোস নামেই জানি।
এটার ছোট একটি কান্ড মাটি কিংবা পানিতে ফেলে দিলেও সেখানে থেকে পরিপূর্ণ একটা গাছ তৈরি হয়ে যায় এবং এই গাছটি সহজে মরে না। এজন্য এটাকে অনেকেই ডেভিল’স আইভি (Devil’s Ivy) বলেও ডাকে।
ঘরের মধ্যে অল্প আলোতে খুব সহজেই মানিপ্ল্যান্ট লাগানো যায়। এটা মাটি ও পানি উভয় মাধ্যমেই খুব ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারে।
তাই যারা শহরে থাকে এবং পুষ্টিকর মাটির অভাব তারা পানিতে এটি লাগাতে পারেন। এজন্য প্লাস্টিকের বোতল কিংবা টব ব্যবহার করা যেতে পারে।
এই গাছের পাতাগুলো অনেকটা মাকড়সার পায়ের মতো দেখতে, এজন্য সবাই এটাকে স্পাইডার প্ল্যান্ট নামেই ডাকে এবং এই নামেই সমধিক পরিচিত। এটি বাতাসে ফরমালডিহাইডের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।
এই গাছটির আদি নিবাস আফ্রিকা এবং এটি শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো ঠান্ডা আবহাওয়াতেও বেড়ে উঠতে পারে। স্পাইডার প্ল্যান্ট ছোট টবে লাগিয়ে ঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখলে তা বেশি সুন্দর দেখায়।
আমরা যারা গাছ নিয়ে ঘাটাঘাটি করেছি তাদের প্রায় সকলেই অ্যালোভেরা গাছটির সাথে সুপরিচিত। এটার ঔষধি গুণাবলির জন্য আমাদের দেশের বেশিরভাগ বাসা বাড়িতেই লাগানো হয়।
মেয়েরা ত্বকের যত্নে ব্যাপকভাবে অ্যালোভেরা ব্যবহার করে এবং অনেকে গরমের সময়ে শরীর ঠান্ডা রাখতে অ্যালোভেরা দিয়ে সরবত তৈরি করেও পান করে।
আপনি চাইলে অন্যান্য গাছের সাথের ঘরের মধ্যে অ্যালোভেরাও রাখতে পারেন। যদিও এটি আলো-বাতাসপূর্ণ স্থানে বেশি ভালোভাবে বৃদ্ধি পায়, তবে স্বল্প আলোতেও মোটামুটি ভালোভাবেই মানিয়ে নিতে পারবে।
আমাদের সকলের কম-বেশি চেনাজানা একটি গাছ হলো ক্যাকটাস। যেটাকে অনেকেই সাকুলেন্ট নামেও জানে। এটি আকারে খুবই ছোট ও দেখতে প্রচন্ড সুন্দর হওয়াই সকলের পছন্দের শীর্ষে থাকে।
সাকুলেন্ট বা ক্যাকটাস গাছের অনেক বেশি প্রজাতি রয়েছে। ফলে এর কোনো না কোনো একটি প্রজাতি ইন্ডোর প্ল্যান্ট হিসেবে আপনার ভালো লাগতে পারে।
ক্যাকটাসের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটা কম যত্নেই খুব সুন্দর বেড়ে উঠতে পারে, আর পর্যাপ্ত যত্ন করলে তো সোনায় সোহাগা! টানা কয়েকদিন পানি না দিলেও এই গাছ আপনাকে হতাশ করবে না।
যেহেতু সাকুলেন্ট বা ক্যাকটাসের অনেক বেশি প্রজাতি আমাদের দেশে পাওয়া যায় তাই এর কয়েকটি প্রজাতি আপনার ইন্ডোর প্ল্যান্টের সংগ্রহে থাকা উচিত।
স্নেক প্ল্যান্ট নামটা শুনে এটাকে কোনো বিষাক্ত গাছ মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এর নামকরণ করা হয়েছে হয়তো সাপের মতো দেখতে এর লম্বা ও গাঢ় সবুজ রঙের পাতার জন্য।
এটাও খুবই উপকারী একটা ইন্ডোর প্ল্যান্ট। বাতাসে দূষণের মাত্রা কমাতে এটা ব্যাপক সহায়তা করে থাকে। এছাড়া এই গাছটি দেখতেও অসম্ভব সুন্দর।
আমাদের দেশের গ্রামে অনেকের বাড়িতেই এই গাছটিকে অযত্নে বেড়ে উঠতে দেখা যায়। এই গাছের বেশি যত্নের প্রয়োজন পড়ে না। শুধু সময় মতো পানি দিলেই চলে।
নাম শুনে লাকি ব্যাম্বুকে কোনো বাশ জাতীয় গাছ মনে হলেও আসলে এটা বাশ নয়। এরা মূলত মাটির পরিবর্তে পানিতে বেড়ে ওঠে।
লাকি ব্যাম্বু আফ্রিকা অঞ্চলের একটি গাছ। এটা দেখতে অনেকটা বাশের মতো এবং আফ্রিকার লোকজন এটাকে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে জানে। সম্ভবত এজন্য একে লাকি ব্যাম্বু নামকরণ করা হয়।
যেকোনো গাছের যত্ন ও পরিচর্যা তার সৌন্দর্য ও সজীবতা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। আমরা বেশিরভাগ মানুষই ইন্ডোর প্ল্যান্ট লাগায় ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য। তাই ইন্ডোর প্ল্যান্টের ক্ষেত্রে যত্ন ও পরিচর্যা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আর্টিকেলের এই অংশে আমরা ইন্ডোর প্ল্যান্টের যত্ন ও পরিচর্যা বিষয়ক কিছু টিপস জেনে নিবো।
আশা করি সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ে আপনার ভালো লেগেছে। ইন্ডোর প্ল্যান্ট সম্পর্কে আরো বলতে গেলে আর্টিকেলটি অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে, যা অনেকের কাছে বিরক্তিকর মনে হতে পারে।
এছাড়া ইন্ডোর প্ল্যান্ট সম্পর্কে আপনার কোনো প্রশ্ন বা মতামত থাকলে তা কমেন্ট করে জানাতে পারেন।
December 7, 2022