উত্তরাবাসীর জন্য এলিভেটে এক্সপ্রেসওয়ে

উত্তরাবাসীর জন্য এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে: যানজটের সমাধান, সময়ের সাশ্রয়, এবং উন্নত জীবনযাত্রার প্রতিশ্রুতি

April 29, 2024

যানজটের নগরী ঢাকায় গত ১৫ বছরে যানবাহনের গড় গতি ২১ কিলোমিটার থেকে কমে ১৬ কিলোমিটারে নেমে গিয়েছে। বুয়েটের এআরআইয়ের এক গবেষণা বলছে, তীব্র এই যানজটের কারণে প্রতিদিন প্রায় ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। অর্থের হিসাবে যা ১৩৯ কোটি টাকার সমান।

এই যখন ঢাকার যানজটের করুন অবস্থা, ঠিক তখন ঢাকাবাসীর যানজট নিরসনে আশার আলো হিসেবে ধরা দিয়েছে বাংলাদেশের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। প্রায় ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১১ সালে হাতে নেওয়া এই প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ হবে ২০২৪ এর জুনে।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা থেকে শুরু করে মগবাজার হয়ে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের কতুবখালী পর্যন্ত প্রায় ১৯.৭৩ কিলোমিটার দৈঘ্যের এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা হয়।  গত ২রা সেপ্টেম্বর বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত ১১.৫ কিলোমিটার অংশ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়টি ঢাকার উত্তর-দক্ষিনে বিকল্প সড়ক হিসেবে কাজ করবে। যার পুরো প্রকল্প শেষ হলে পুরো রাজধানীকে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের সাথে এক্সপ্রেসওয়েটি যুক্ত করবে।

রাজধানী ঢাকার মহাসড়কগুলোতে নানাবিধ বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি দিয়ে বিরামহীনভাবে যান চলাচলের সুযোগ করে দিবে এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। যেহেতু বিরামহীন যাত্রাই কেবল থাকবে, তাই অন্য মহাসড়কের যানবাহনের তুলনায় কম সময় বিশেষ করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছে যাবে চলাচলকারীরা৷ এতে ঢাকা শহরের তীব্র যানজট যেমন অনেকাংশে কমে যাবে, পাশাপাশি ভ্রমণের সময় ও খরচ তুলনামূলক হ্রাস পাবে।

উত্তরাবাসীর জন্য এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কী কী সুবিধা নিয়ে আসলো?

উত্তরা রাজধানী ঢাকা শহরের সবচেয়ে সুপরিকল্পিত নগরী এবং ঢাকার অভিজাত এলাকার একটি। বানিজ্যিক ও আবাসিক প্রধান কেন্দ্রস্থল হওয়ায় উত্তরা নগরের ব্যাবস্থাপনা রাজধানী ঢাকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অন্যতম প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বানিজ্যিক ও আবাসিক প্রধান কেন্দ্র উত্তরা নগরের চিত্র যেন বদলে দিয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বানিজ্যিক ক্ষেত্র এবং আবাসনের প্রধান কেন্দ্রস্থল উত্তরার নগরীর যোগাযোগ ক্ষেত্রের অনন্য ক্ষেত্র এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সবচেয়ে বেশি সুফল পাবে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মাধ্যমে উত্তরাবাসীর জন্য যেসব সুবিধা বয়ে নিয়ে এসেছে তা সম্পর্কে আলোকপাত করছি।

যানজট নিরসন

প্রশস্ত রাজপথ আর চোখ জুড়ানো ভবনে ঘেরা বানিজ্যিক ও আবাসিক কেন্দ্রস্থল উত্তরা নগরের জন্য যানজট যেন এক বিভীষিকা ও আতঙ্কের নাম। বিশেষ করে অফিসমুখী যাত্রী এবং বিদেশগমন করা যাত্রীরা এর সবচেয়ে বড়ো ভুক্তভোগী। বিমানবন্দরকেন্দ্রিক যাত্রীদের সড়কে চলার সময় মুহুর্তে মুহুর্তে দেখতে হয় গুগল ম্যাপের ট্র্যাফিক আপডেট।

অনেকে এজন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হবে ভেবে গাড়ি থেকে নেমে  ফ্লাইট মিস করার ভয় নিয়ে লাগেজ মাথায় নিয়ে হেটেঁ চলার চেষ্টা করেন  বিমানবন্দরের অভিমুখে। আবার অফিসগামী যাত্রীদের নির্দিষ্ট সময়ে প্রবেশ করতে হয়, তাই বিড়ম্বনা ও সীমাহীন দুর্ভোগ তাদের চাকরি জীবনে ফেলে নানান প্রভাব।

তবে সকল বিড়ম্বনা ও দূর্ভোগের বিপরীতে আশার আলো হিসেবে ধরা দিয়েছে বাংলাদেশের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের বলছে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি চালু হবার পর বিমানবন্দর ও উত্তরাকেন্দ্রিক সড়কগুলোতে যে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হতো তা কমে যাবে অনেকটা।

এতে অফিসগামী যাত্রীরা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে মাত্র ১০ মিনিটে বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট  আসা-যাওয়া করতে পারবেন।

দূরত্ব কমে যাওয়া ও নিরাপত্তা বৃদ্ধি

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যেহেতু স্থলপথের উপরে চলাচল করবে, তাই যেকোনো  স্থলপথের তুলনায় অনেক বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। এক্সপ্রেসওয়েতে যেহেতু এক লেনের যানবাহনই চলাচল করবে তাই উত্তরা মুখী যেকোনো যাত্রীগন নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই গন্তব্যে  পৌঁছাতে পারবে। যেই সুবিধা এর আগে পাওয়াটা দুষ্কর ছিলো।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে সকল ধরনের যানবাহন চলাচল করতে পারবে না, তাই যানবাহনের সংখ্যা অন্যান্য সড়কের তুলনায় অল্প থাকবে এবং তা  স্থলপথের তুলনায় অনেকটাই নিরাপদ থাকবে। এখানে অন্যান্য যানবাহনের পাশাপাশি পথচারী, হকার এবং পশুপাখির ঝামেলা একদমই নেই । এতে উত্তরা মুখী যাত্রীদের সড়কের নিরাপত্তা নিয়ে যে উদ্বিগ্নতা ছিলো তা অনেকাংশে কেটে যাবে।

নান্দনিক সৌন্দর্য উপভোগ

স্থলপথে সড়কের যানবাহনগুলোতে চলাচল করলে সড়কের আশেপাশের আবর্জনার স্তুপ, বিভিন্ন খুটির তার এবং নির্মাণ খাতের বর্জ্যের মুখোমুখি হওয়া যেন স্বাভাবিক ব্যাপার।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে এই ধরনের সমস্যার সুযোগ একেবারেই নেই, তাই আবাসিক ও বানিজ্যিক কেন্দ্রস্থলের উত্তরার সড়কের দুপাশে  অবারিত স্থাপনা ও কাশপুলের বিচরন দেখে তৃপ্তিদায়ক ভ্রমণের সুযোগ মিলবে।

স্থলপথে চলাচলের ফলে নানাবিধ সমস্যার কারনে পুরো শহরকে উপভোগ করার সে সুযোগটা হতো না। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে উত্তরাবাসীকে তার শহরটাকে দ্রুত এবং আনন্দদায়ক ভ্রমনের পাশাপাশি পাখির দৃষ্টিকোনে দেখার সুযোগ করে দিবে।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন

উত্তরা হচ্ছে রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে পরিকল্পিত ও অভিজাত শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। রাজধানী ঢাকার যতগুলো আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে, তাদের অন্যতম উপভোগ্য স্থান হচ্ছে উত্তরা। বেসরকারি  আবাসিক কোম্পানি বি-প্রপার্টীর তথ্যমতে বসবাসের জন্য রাজধানীবাসী তাদের প্রথম পছন্দ হিসেবে  মনে করছে উত্তরা আবাসিক এলাকা।

তবে যোগাযোগের ক্ষেত্রের কিছুটা দূর্বলতর অবস্থার কারনে বসবাসের যোগ্য এই শহরটির আবাসিক খাতের চাহিদা ছিলো কিছুটা নিম্ন।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে উত্তরার আবাসিক খাতে আরো একধাপ এগিয়ে নেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে এখন কাজ করবে। অল্প সময়ে, বিরামহীন যাত্রা এবং প্রকৃতিকে উপভোগ করার এই সুযোগ উত্তরার আবাসিক সেক্টরের অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক নতুর দ্বার হিসেবে আবিভূত হয়েছে।

যোগাযোগ ক্ষেত্রের উন্নয়নের কারণে অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় উত্তরায় বর্তমান এবং আগামীতে অ্যাপার্টমেন্টের চাহিদা ও ভিত্তিমূল্য আরো ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিনোদনের ক্ষেত্র সৃষ্টি

রাজধানী ঢাকায় ব্যস্ত জনজীবনে ছুটির দিনগুলোতে কোথাও বেড়িয়ে আসা কিংবা বিনোদন নেবার সুযোগ খুব একটা পাওয়া যায় না। তবে যখনই সুযোগ মেলে ঠিক তখনই , বিনোদন কেন্দ্র, সেক্টর পার্ক ও অবারিত কাশফুলের বিচরণের ক্ষেত্র উত্তরা এক্ষেত্রে রাজধানীবাসির প্রথম চয়েস হিসেবে থাকে। কি নেই এখানে? শিশুদের বিনোদন কেন্দ্র থেকে শুরু করে পারিবারিক বিনোদন কেন্দ্র, মনোরম সেক্টর পার্ক, খেলার মাঠ এবং দিগন্ত জোড়া কাশফুলের বন উত্তরার ১৫নং সেক্টরের দিয়াবাড়ি সবই রয়েছে।

তবে, প্রায়সময় যানজটের অসহনীয় চাপের ভয়ে বিনোদন নগরীতে যাবার চেষ্টা থেকে সরে আসেন। এতে বিনোদন কেন্দ্রগুলোর সাথে গড়ে উঠা ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো খুব একটা দর্শনার্থী পায় না। এবার সেই চিত্র পুরোপুরি বদলিয়ে দিচ্ছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।

সময় ও ভোগান্তি দুটোই তুলনামূলক কম থাকার কারনে অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন উত্তরার বিভিন্ন সেক্টরে গড়ে উঠা নানাবিধ কেন্দ্রগুলো  থাকবে দর্শনার্থীতে ভরপুর।

এছাড়াও মিডিয়া জগতের প্রায় নাটকের মূল দৃশ্যপটের শুটিং করার জন্য পরিচালকদের  প্রথম পছন্দ হচ্ছে উত্তরা। নিরবিচ্ছিন্ন ভ্রমনের সুযোগ  এবং ভোগান্তির নাগাল থেকে মুক্তি দেওয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এখন সেই সম্ভাবনাও আরো বাড়িয়ে দিবে।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটির পুরো প্রকল্পের মধ্যে মাত্রা ৬৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।  অর্থাৎ বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত অংশ খুলে দেওয়া হয়েছে। তেজগাঁও থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত বাকি থাকা অংশের কাজ আগামী জুনের মধ্যে শেষ হবার কথা রয়েছে।

পুরো প্রকল্প শেষ হলে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের আওয়াত এরিয়াগুলোতে যোগাযোগের এক নতুন ক্ষেত্র হিসেবে উন্মোচিত হবে।

Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments