নিজের একটি ফ্ল্যাট, এই স্বপ্ন অনেকেরই থাকে। আর সেই স্বপ্ন যখন সত্যি হয়, তখন প্রতিটি ধাপ নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করাও জরুরি! ফ্ল্যাট কেনার পর মালিকানার স্বীকৃতির পাশাপাশি আইনগত সুরক্ষার জন্য ‘নামজারি’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রক্রিয়া।
নামজারির মাধ্যমে সরকারি রেকর্ডে নতুন মালিকের নামে ফ্ল্যাটের মালিকানা নিবন্ধন নিশ্চিত করা হয়, যা সিটি কর্পোরেশন অধ্যাদেশ ২০২০ এবং রেজিস্ট্রেশন আইন ১৯০৮ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। নামজারি ছাড়া কোনো সম্পত্তির মালিকানা বৈধভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় না এবং ভবিষ্যতে বিক্রয় বা উত্তরাধিকার সংক্রান্ত যে কোনো আইনি জটিলতা এড়ানোর জন্য এটা একটা আবশ্যকীয় ধাপ।
অনেকেই মনে করেন, ফ্ল্যাট কেনার পর রেজিস্ট্রি দলিল থাকলেই তা যথেষ্ট। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নামজারি সম্পন্ন না হলে সরকারিভাবে ফ্ল্যাটের মালিকানা আপনার কাছে হস্তান্তর হবেন না।
এই ব্লগে আমরা ফ্ল্যাট নামজারির সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, সম্ভাব্য খরচ এবং কিছু সমস্যা ও তার সমাধান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
Contents
বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, যেকোনো প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক যিনি বৈধভাবে ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন তিনি তার ক্রয়কৃত সম্পত্তির (ফ্ল্যাট) জন্য নামজারির জন্য আবেদন করতে পারেন। যেমনঃ
বৈধ ক্রেতাঃ ফ্ল্যাট ক্রয়ের দলিলে (Registration Deed) যার নাম রয়েছে। অর্থাৎ আবেদনকারী ও ক্রেতার নাম একই হতে হবে।
যৌথ মালিকানাঃ স্বামী-স্ত্রী, ব্যবসায়িক পার্টনার বা পরিবারের সদস্যদের সাথে যৌথভাবে ফ্ল্যাট ক্রয় করলে সেক্ষেত্রে যৌথ আবেদন করা যাবে।
উত্তরাধিকারীঃ মৃত মালিকের বৈধ ওয়ারিশগণ (ওয়ারিশ সনদ বা কোর্টের প্রোবেট সার্টিফিকেট সহ) তাদের প্রাপ্ত অংশ নিজ নামে নিবন্ধনের জন্য নামজারির আবেদন করতে পারবেন।
পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি ধারীঃ মূল মালিক কর্তৃক লিখিতভাবে অর্পিত ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি নিজ নামে নামজারির আবেদন করতে পারবেন।
ফ্ল্যাট কেনার পর নামজারি আবশ্যক। কেননা এটিই আপনাকে সরকারিভাবে মালিকানার স্বীকৃতি দেবে। এছাড়া নামজারি ছাড়া আপনার নামে গ্যাস, বিদ্যুৎ সংযোগ বা হোল্ডিং ট্যাক্স দিতে পারবেন না। নামজারি ছাড়া পরবর্তী এটি বিক্রি, বন্ধক বা জামানত দিয়ে ব্যাংক লোনের আবেদন করতে পারবেন না।
ফ্ল্যাট নামজারির জন্য আবেদন করার সময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র জমা প্রয়োজন হয়। নিচে একটি তালিকা দেওয়া হলোঃ
এছাড়াও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অন্যান্য কাগজপত্র প্রয়োজন হতে পারে। এবং কাগজপত্রের ফটোকপি ১ম শ্রেণীর গেজেটেড অফিসার বা নোটারি পাবলিক দ্বারা সত্যায়িত সত্যায়িত করা লাগতে পারে।
বর্তমানে সরাসরি সংশ্লিষ্ট অফিসে উপস্থিত হয়ে ফ্ল্যাট নামজারির আবেদনের পাশাপাশি অনলাইনে ঘরে বসেও আবেদন করা যায়। নিচে দুইটি পদ্ধতি সম্পর্কেই সংক্ষেপে ধারণা দেওয়া হলো।
১. অফলাইনে আবেদন
ফ্ল্যাটের অবস্থান অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার-ভূমি (AC Land) অফিসে যেতে হবে এবং সেখানে নামজারির জন্য আবেদন ফরম সংগ্রহ করে ফরমটি যথাযথভাবে পূরণ করতে হবে।
পূরণকৃত আবেদন ফরমের সাথে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের ফটোকপি জমা দিতে হবে। দায়িত্বরত কর্মকর্তা প্রয়োজনে কাগজের আসল কপি দেখতে চাইতে পারেন। সেজন্য অরিজিনাল কপি সাথে নিয়ে যাওয়াই ভালো।
আপনার এলাকা অনুযায়ী নির্ধারিত আবেদন ফি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে চালানের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হবে। এরপর চালানের কপিটিও আবেদনের সাথে যুক্ত করে দিতে হবে।
২. অনলাইনে ফ্ল্যাট নামজারির আবেদন
ভূমি মন্ত্রণালয়ের ই-মিউটেশন ওয়েবসাইট বা মোবাইল অ্যাপে আবেদনকারীর নাম, মোবাইল নাম্বার, ইমেইল ও জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে একটা অ্যাকাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।
অ্যাকাউন্ট খোলার পরে ওয়েবসাইট বা অ্যাপে ফরম পূরণ করতে হবে এবং সেখানে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের স্ক্যান কপি (PDF, JPEG ফরম্যাটে, সর্বোচ্চ 2 MB) আপলোড করতে হবে।
সর্বশেষ আবেদন জমা দেওয়ার সময় নির্ধারিত আবেদন ফি বিকাশ, নগদ, রকেট অথবা ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে পরিশোধ করতে পারবেন। আবেদন সফলভাবে জমা দেওয়া হলে পেমেন্টের রশিদ ডাউনলোড করে রাখুন।
অ্যাপে বা ওয়েবসাইটে Application ID ব্যবহার করে আবেদনের স্ট্যাটাস চেক করতে পারবেন।
কর্তৃপক্ষ ফ্ল্যাট পরিদর্শন করে অফিসে রিপোর্ট জমা দেবেন। কোনো জটিলতা বা কাগজপত্রে সমস্যা না থাকলে সাধারণত ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যে নামজারি সার্টিফিকেট ইস্যু করে থাকে। মোটামুটি এক মাসের মধ্যে আপনার ক্রয়কৃত ফ্ল্যাটের নামজারি সম্পন্ন করতে পারবেন।
রাজউকের আওতাধীন কোনো ফ্ল্যাট হলে আবেদনের সময় কোনো ফি প্রদান করতে হয় না। রাজউক কর্তৃক আবেদনটি অনুমোদিত হলে নামজারি ফি বাবদ ১০ হাজার টাকা ও এর উপরে ১৫% ভ্যাটসহ অনলাইনে জমা দিতে হবে।
আর যদি ফ্ল্যাটটি রাজউকের আওতামুক্ত হয় তাহলে (কোর্ট ফি ২০, নোটিশ জারি ফি ৫০, রেকর্ড হালনাগাদ ফি ১০০০ এবং নামজারি খতিয়ান সরবরাহ বাবদ ১০০ টাকা সহ) সর্বমোট ১১৭০ টাকা জমা দিতে হবে।
নামজারির আবেদন করার সময় বা পরবর্তীতে অনেকেই যেসব সমস্যা পড়েন সেগুলোর কিছু আলোচনা করা হলো।
নামজারি আবেদন বাতিল হলে করণীয়ঃ নামজারি বা মিউটেশন আবেদন করার সেটা বাতিল হয়ে গেলে কেন বাতিল করা হয়েছে তা খুঁজে বের করুন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কাগজপত্রের গড়মিলের কারণে আবেদন বাতিল করা হয়। এক্ষেত্রে কাগজপত্র সংশোধন করে আবার আবেদন করতে পারবেন।
ভুল তথ্য সংশোধনের পদ্ধতিঃ কোনো ভুল তথ্য সংশোধনের জন্য সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিলে এবং দায়িত্বরত কর্মকর্তা সন্তোষজনক দেখলে ভুল তথ্য সংশোধন করে দেবেন।
দালাল ও প্রতারণা থেকে সাবধানতাঃ বাংলাদেশে যত সেক্টরে দালাল ও অনিয়ম রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এই ভূমি বা ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন, নামজারি ক্ষেত্রে ভূমি অফিস। দালাল থেকে সবসময় সাবধান থাকবেন। তারা বিভিন্নাভাবে আপনাকে প্রলুব্ধ করতে চাইবে। তবে কাগজপত্র সঠিক থাকলে আপনি তাদের সহায়তা ছাড়াই সরকার নির্ধারিত ফি জমা দিতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফ্ল্যাটের নামজারি করতে পারবেন।
ফ্ল্যাটের নামজারির আবেদন ফরম অনলাইন থেকে ডাউনলোড করার প্রয়োজন নেই। আপনি ওয়েবসাইটে বা মোবাইল অ্যাপে আবেদন করার সময় ফরম পাবেন। আর সরাসরি ভূমি অফিসে গিয়ে আবেদন করলে সেখান থেকে আপনাকে ফরম সরবরাহ করবে। এছাড়া আপনার নিকটস্থ ভূমি অফিসের ঠিকানা খুঁজে পেতে গুগল ম্যাপে সার্চ করতে পারেন।
নামজারি প্রক্রিয়া সফলভাবে সম্পন্ন হলে ফ্ল্যাটের মালিকানা সরকারিভাবে আপনার নামে নিবন্ধিত হবে। এটা ভবিষ্যতে যে কোনো আইনি সমস্যা এড়াতে আপনাকে সাহায্য করবে। ফ্ল্যাট কেনার পর দ্রুত নামজারি করে ফেলুন যাতে পরবর্তী সময়ে কোনো জটিলতা তৈরি না হয়।
নামজারি করা শুধু আইনগত দায়িত্বই নয়, বরং এটি আপনার স্থাবর সম্পত্তির সুরক্ষা নিশ্চিত করার অন্যতম মাধ্যম। আশা করি, এই গাইডলাইনটি আপনাকে ফ্ল্যাট নামজারি করতে কি কি লাগে এবং কীভাবে আবেদন করতে হয় সে বিষয়ে বুঝতে সহায়ক হবে।