30 May 2022

জমি বন্ধক রেখে ব্যাংক লোন (মর্টগেজ লোন) এর বিস্তারিত

বাড়ি কেনা সহ অনেক ধরনের বড় অঙ্কের সম্পদ কেনার স্বপ্ন অনেকেরই থাকে। কিন্তু কিছু কারণে সে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে আর সময় হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় যে বিষয়টি, সেটা হলো অর্থসংকট।

হয়তো পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে আপনার স্বপ্নটাও ডানা মেলতে পারছে না। তবে এই সমস্যার সবচেয়ে ভালো সমাধান হতে পারে মর্টগেজ ঋণ বা বন্ধকী ঋণ।

আজকের এই সম্পূর্ণ লেখাজুড়ে আমরা জানার চেষ্টা করবো মর্টগেজ লোন কী, কীভাবে এটি পাওয়া যায়, কী কী শর্ত পূরণ করতে হয় ইত্যাদি সহ মর্টগেজ লোনের আদ্যোপান্ত। তাহলে আসুন মূল আলোচনায় ঢুঁ মারা যাক।

মর্টগেজ লোন কী

ব্যাংক বা কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে স্থায়ী সম্পদ জামানত রেখে তার বিপরীতে ঋণ গ্রহণ করাকেই বলা হয় বন্ধকী ঋণ বা মর্টগেজ লোন (Mortgage Loan)। এই ঋণ সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি সময়ের জন্য নেওয়া হয়। যার মেয়াদকাল ৫-২০ বছর কিংবা তার বেশিও পারে।

মর্টগেজ লোনের ক্ষেত্রে ব্যাংকের কাছে স্থায়ী সম্পদ জামানত হিসেবে রাখতে হয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত জামানত মাধ্যমটি হচ্ছে জমিল দলিল। অনেক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ বা কোনো স্থায়ী সম্পদ কেনার উদ্দেশ্যে মর্টগেজ লোন নিয়ে থাকে।

উদাহরণস্বরূপ- মনে করুন, আপনি একটি বাড়ি নির্মাণ করতে চান। বাড়ির তৈরির জন্য প্রয়োজন জমি ও নির্মাণ সামগ্রী। আপনার উপার্জিত অর্থ দিয়ে জমি কিনতে পারলেও আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করতে পারছেন না। এমতাবস্থায় এই বন্ধকী ঋণ বা মর্টগেজ লোন হতে পারে সবচেয়ে সহজ ও যথোপযুক্ত সমাধান।

আপনি যে জমিটি ক্রয় করেছেন সেটার দলিল কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে জমা রেখে নির্দিষ্ট মেয়াদের ভিত্তিতে ঋণ নিতে পারেন। এবার ঋণকৃত অর্থ দিয়ে দ্রুত বাড়ি তৈরির কাজ সেরে ফেলতে পারেন।

এই ঋণের সম্পূর্ণ অর্থ এককালীন অথবা কতগুলো সমান কিস্তিতে পরিশোধ করা যায়। যখন সুদাসলে সম্পূর্ণ ঋণ পরিশোধ হয়ে যাবে তখন জমাকৃত ঋণের দলিল ফেরত পেয়ে যাবেন।

আশা করি, মর্টগেজ ঋণ সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ও সুন্দর ধারণা পেয়েছেন। এবার আসুন এই বিষয়ে সর্বাধিক জিজ্ঞাসিত কিছু প্রশ্নের উত্তর জেনে নেওয়া যাক।

Video Credit: LAWSNLAWYERS

আমি কেন মর্টগেজ লোন নেবো?

এই প্রশ্নের উত্তর আপনি নিজেই সবচেয়ে ভালো জানেন। সাধারণত মর্টগেজ লোন নেওয়া হয় একটি স্থায়ী সম্পত্তি বন্ধক রেখে অপর একটি স্থায়ী সম্পত্তি ক্রয় বা প্রকল্পে বিনিয়োগ করার জন্য অর্থের যোগান দিতে।

যেহেতু এখন আপনার কাছে একটি সুযোগ আছে, কিন্তু পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে তা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারছেন না তাই এই অর্থের যোগানদাতা হতে পারে ব্যাংক বা কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ব্যাংককে সহজে ঋণদানে রাজী করাতে আপনার কোনো সম্পত্তি বন্ধক রাখতে পারেন।

এই লোন নেওয়ার কতগুলো সুবিধা আছে।

সেগুলো হলো –

  • সহজে পর্যাপ্ত অর্থের যোগান পাওয়া যায়
  • সুদের হার বহনযোগ্য মাত্রায় থাকে
  • ‌কতগুলো সমান কিস্তিতে ঋণের অর্থ পরিশোধের সুযোগ আছে
  • সম্পত্তি বিক্রয়ের প্রয়োজন পড়ে না
  • এছাড়াও আপনি যে সম্পত্তিটি বন্ধক রাখবেন সেটা আপনি নিজে ব্যবহার করতে পারবেন। শুধু ব্যাংক সেটার মালিকানা পাবে, তবে ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া আপনি সেটা বিক্রি বা হস্তান্তর করতে পারবেন না, যথেচ্ছ ব্যবহার করতে পারবেন।

Also Read: বাংলাদেশে হোম লোনের জন্য সেরা ব্যাংক

মর্টগেজের প্রক্রিয়াটি কীভাবে শুরু করবো?

মর্টগেজ প্রক্রিয়াটি শুরু করার জন্য প্রথমেই একটা আর্থিক পরিকল্পনা করে নেওয়া জরুরি। আপনার কী পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন আর কত টাকা লোন নিতে চাচ্ছেন সেটার একটা লিখিত পরিকল্পনা করে ফেলুন।

এবার বন্ধকী ঋণ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশে প্রচলিত ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্টানগুলো খুঁজে বের করুন। এক্ষেত্রে ইন্টারনেট আপনাকে অনেকটা সহযোগিতা করবে। এপর্যায়ে ঋণের সুদের হার, ঝুকি, নিরাপত্তা, ব্যাংকের সুনাম, শর্ত ইত্যাদি বিষয় বিচার বিশ্লেষণ করে কতগুলো ব্যাংকের তালিকা তৈরি করুন।

এই তালিকা থেকে আপনার সবচেয়ে পছন্দনীয় ব্যাংকটি নির্বাচন করুন এবং আরো বিস্তারিত জানতে তাদের সাথে ফোন কলে অথবা সরাসরি সাক্ষাতে যোগাযোগ করুন। আপনার চাহিদা ও সক্ষমতা তাদের শর্তের সাথে মিলে গেলে ঋণ প্রদানের জন্য পরবর্তী সকল প্রক্রিয়া তারাই আপনাকে জানাবে।

তবে এ বিষয়ে খুব আত্মবিশ্বাস না পেলে অভিজ্ঞ কারো সহায়তা নিন বিকল্প ব্যাংক নির্বাচনের ক্ষেত্রে।

আমি কি মর্টগেজ লোন পেতে উপযুক্ত?

যারা মর্টগেজ লোন নিতে আগ্রহী তাদের সবার মনেই এই প্রশ্নটি এক বা একাধিক বার এসেছে, এ বিষয়ে আমি মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি। ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যাংক তাদের নিজস্ব নীতিমালা অনুসরণ করে থাকে। তাই প্রতিষ্ঠান ভেদে ঋণ পেতে যোগ্যতা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।

তবে ব্যাংকিং বিধিমালা অনুযায়ী, মর্টগেজ ঋণ পেতে হলে আবেদনকারী ব্যক্তিতে অবশ্যই সাবালক ও উপার্জক্ষম হতে হবে এবং ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত স্থায়ী সম্পত্তি বন্ধক রাখতে হবে। এগুলো ছাড়াও প্রতিটি ব্যাংকে আলাদা আলাদা শর্ত উল্লেখ থাকে।

আপনার বয়স যদি ২১ বছরের উর্ধে হয়, আপনি উপার্জনে সক্ষম হন এবং আপনার পর্যাপ্ত স্থায়ী সম্পদ থাকে তাহলে এই ঋণের জন্য আপনি উপযুক্ত বলে বিবেচিত হতে পারেন।

এখন আপনার মাথায় প্রশ্ন আসতে পারে, বন্ধকী সম্পদের বিপরীতে কী পরিমাণ ঋণ পাওয়া যায়?
নিজস্ব মালিকানাধীন যেকোনো স্থায়ী সম্পদের বিপরীতে মর্টেগজ লোন পাওয়া যায়। যেমন ভূমি, দালানকোঠা, নির্মানাধীন দালান, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি। আমাদের দেশে সাধারণ বন্ধকী জামানতের বর্তমান মূল্যের বিপরীতে ৫০-৮০ শতাংশ হারে ঋণ দেওয়া হয়।

একেক প্রতিষ্ঠানে ঋণ প্রদানের হার একেকরকম হয়ে থাকে। তবে ৫০% এর বেশি ঋণ পাবেন এ বিষয়ে মোটামুটি নিশ্চিত হয়েই বলা যায়।

ধরুন, আপনি একটা জমি কিনেছেন ৮ লাখ টাকা দিয়ে যার বর্তমান মূল্য ১০ লাখ টাকা। যদি ৬০% হারে ঋণ প্রদান করে তাহলে আপনি ৬ লাখ টাকা ঋণ পেতে পারেন। অর্থাৎ সম্পদের বর্তমান মূল্য সাপেক্ষে ঋণের পরিমাণ নির্ধারন করা হবে।

মর্টগেজ লোন পেতে কত সময় লাগে?

অন্যান্য ব্যক্তিগত লোনের চেয়ে মর্টগেজ লোনের ক্ষেত্রে কিছুটা বিলম্ব হয়। সাধারণত এক থেকে দের মাসের মধ্যেই এই ঋণ অনুমোদন পাওয়া যায়। তবে প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা, কার্যক্রম প্রভৃতি ভেদে এই সময় কম-বেশি হতে পারে।

অনেক সময় জামানতকৃত সম্পত্তির মূল্যায়নে জটিলতা সৃষ্টির কারণে লোন অনুমোদন পেতে দেরি হয়। আবার কখনো কখনো সকল কাগজপত্রের মাঝে মিল না থাকলে লোন পেতে দেরি হয়।

এটা মূলত অনেকগুলো বিষয়ের উপরই নির্ভর করে। তবে সাধারণভাবে বলা যায় আমাদের দেশে ৩০-৪৫ দিনের মধ্যেই মর্টগেজ লোন বা বন্ধকী ঋণের অনুমোদন পাওয়া যায়।

Also Read: বাংলাদেশের বিভিন্ন ধরনের হোম লোন সমুহ

মর্টগেজ লোন নিতে কী কী ডকুমেন্ট লাগবে?

মর্টগেজ লোন নিতে প্রাথমিক পর্যায়ে আবেদনের সময় কিছু কাগজপত্র জমা দিতে হয় এবং ঋণ পাশের পূর্বে চুড়ান্ত পর্যায়ে আরো কিছু কাগজপত্র জমা দিতে হতে পারে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি, জামানতের ধরনের উপর ভিত্তি করে কাগজপত্র ভিন্ন হয়ে থাকে।

তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাধারণ কিছু কাগজপত্র প্রয়োজন পড়ে যা সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এরকম কিছু ডকুমেন্টের কথা নিচে উল্লেখ করা হলো –

  • ‌গত এক বছরের ট্যাক্স ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট
  • ইউটিলিটি বিলের কপি বা ফটোকপি
  • গত এক বছরের ব্যাংক বিবরণী
  • জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বা পাসপোর্টের কপি
  • জামিনদারের কাগজপত্র
  • বন্ধকযোগ্য সম্পদের দলিলপত্র
  • যন্ত্রপাতি হলে মালিকানা সাপেক্ষে প্রমাণপত্র
  • ঋণের চুক্তিপত্র

এছাড়াও ব্যবসায়ীদের জন্য প্রয়োজন –

  • গত তিন বছরের ব্যবসায়ের ট্রেড লাইসেন্স
  • গত এক বছরের ব্যাংক বিবরণী
  • অংশীদারী ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে অংশীদার চুক্তিপত্র

চাকরিজীবীদের জন্য প্রয়োজন হতে পারে –

  • স্যালারি সার্টিফিকেট
  • এমপ্লয়িমেন্ট সার্টিফিকেট

এখানে উল্লিখিত ডকুমেন্ট ছাড়াও অন্যান্য ডকুমেন্টের প্রয়োজন হতে পারে। আগেই বলেছি, ব্যাংক ভেদে এগুলো ভিন্ন ভিন্ন হয়। তাই সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করে আগে থেকে জেনে নিলে সবকিছু গোছানো সহজতর হয়ে যাবে।

মর্টগেজ লোন নিয়ে মানুষের মনে তৈরি হতে পারে বা হয় এরকম কিছু প্রশ্নের সঠিক ও নির্ভরযোগ্য উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছি। বর্তমান বিশ্ব প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল আর ব্যাংক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানকে মোকাবিলা করার জন্য প্রতিনিয়ত ব্যবসায়িক নীতিমালায় নানারকম পরিবর্তন আনছে।

তাই উপরে প্রদত্ত তথ্য এবং পরবর্তী কয়েক মাস বা বছর পরের অবস্থা সামঞ্জস্য নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে অনুরোধ করবো বর্তমান অবস্থা জানতে ব্যাংকগুলোতে সরাসরি যোগাযোগ করতে।