ভূমিকম্প সহায়ক ভবন নির্মাণ গুরুত্বপূর্ণ কেন

ভূমিকম্প সহায়ক ভবন নির্মাণ গুরুত্বপূর্ণ কেন

February 17, 2024

সম্প্রতি বিশ্বে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু বড় বড় ভূমিকম্প ও সেগুলোর কারনে ঘটা প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি দেখে বিশ্ব মহলে আবারো ভূমিকম্প সহায়ক ভবন নির্মাণ নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে।

কেননা ভূমিকম্পের মত বড় ও মারাত্বক প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করার সাথে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি কমানোর একটায় উপায় আর তা হলে ভূমিকম্প সহায়ক স্থাপনা নির্মাণ করা।

সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া যাওয়া ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর আফগানিস্তানে ৬.৩ মাত্রার ভূমিকম্পে এক হাজারেরও বেশী মানুষ প্রান হারিয়েছিল যার বেশির ভাগই নারী ও শিশু ছিল।

২০২৩ সালেরই ৮ সেপ্টেম্বর পৃথিবী ১০০ বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ভূমিকম্পটি দেখেছিল। মরোক্কোতে হওয়া এই দুর্ঘটনায় ২৯৪৬ জনের প্রাণহানীর খবর পাওয়া যায়। এই ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতিও ছিল ব্যাপক।

একই সালের ৬ ফেব্রুয়ারী তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলে ৭.৭ মাত্রার এক শক্তিশালী ভূমিকম্প হয় যাতে প্রান হারায় ৫০ হাজারেরও বেশী মানুষ। সাম্প্রতিক এইসব ভয়াবহ ভূমিকম্পগুলোর ক্ষয়ক্ষতির পরিমান থেকেই ভূমিকম্প সহায়ক স্থাপনা নির্মানের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়।

ভূমিকম্প সহায়ক ভবন নির্মাণের গুরুত্ব

ভূমিকম্প এমন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেটা মানুষের দ্বারা নিয়ন্ত্রন করা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয় নি। প্রাণহানী ও স্থাপনা ধ্বংসের পাশাপাশি এর নাতিবাচক প্রভাব সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটেও পড়ে। ভূমিকম্পের ভয়াবহ ক্ষতি সহনীয় মাত্রায় রাখার প্রথম ও প্রধান উপায় হচ্ছে ভূমিকম্প সহায়ক ভবন নির্মাণ করা। চলুন দেখি এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে ভূমিকম্প সহায়ক স্থাপনা নির্মান কেন গুরুত্বপূর্ন।

১. মানুষের জীবন রক্ষা

সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ভূমিকম্পে যে পরিমান প্রানহানী ঘটেছে তা সত্যিই লোমহর্ষক। এই বিপুল পরিমান মৃত্যুর অন্যতম কারন হল বেশিরভাগ স্থাপনাই উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প সহ্য করার মত শক্তিশালী ছিল না। তাই ভূমিকম্প সহায়ক ভবন নির্মানের উদ্দেশ্যই হচ্ছে মৃত্যু কমিয়ে আনা। উচ্চমাত্রার কম্পনেও স্থাপনাকে অক্ষত রাখার জন্য ভবনের এর ফাউন্ডেশনের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। ভবনের ভিত মজবুত হলে সেটা জোর ধাক্কা সামলাতে সক্ষম হবে। ভূমিকম্পের সময় যখন কোন দূর্বল স্থাপনা ভেঙ্গে পড়ে তখন তা অভ্যন্তরে থাকা মানুষের পাশাপাশি আশেপাশের ভবন ও মানুষও ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

২. সম্পদের ক্ষতির পরিমান কমিয়ে আনা

ভূমিকম্পে কেবলমাত্র যে প্রাণহানী ঘটে তা কিন্তু নয়। বরং বিপুল পরিমান সম্পদের ক্ষতিও সাধিত হয়। আবাসিক ভবন, অফিস প্রতিষ্ঠান, দোকান পাট সহ নানারকম কলকারখানাও প্রবল কম্পনে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে এমনকি দুর্বল স্থাপনা হলে তা ভেঙ্গে পড়তেও পারে। এর ফলে প্রচুর সম্পদ নষ্ট হতে পারে। এতে দেশের অর্থনীতিও ভেঙ্গে পড়ে। এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারনে একটি দেশ তার বর্তমান অবস্থা থেকে অনেক গুন পিছিয়ে পড়তে পারে। সম্পদের এই বিপুল ক্ষতি পূরন করতে কয়েক দশক পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। ভূমিকম্প সহায়ক স্থাপনা নির্মানের মাধ্যমে এই ক্ষতি অনেকটায় কমিয়ে আনা যায়।

৩. দুর্যোগ পরবর্তী জরুরী সেবা প্রদান

প্রাকৃতিক দুর্যোগ কেটে গেলে সবার আগে যেটা প্রয়োজন হয় সেটা হল যুর্যোগ কবলিত স্থানে জরুরী সেবা প্রদান করা। আর জরুরী সেবা প্রদানের জন্য সবার আগে প্রয়োজন হাসপাতাল এবং তার পরেই পূনর্বাসনের জন্য মজবুত ভবন। আর এর জন্য প্রয়োজন ভূমিকম্প সহায়ক স্থাপনা। জরুরী সেবা প্রদানের প্রয়োজনীয় ভবনগুলোও যদি ভেঙ্গে পড়ে তাহলে দুর্ভোগ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমান অকল্পনীয় হতে পারে। এই কারনে শুধু আবাসিক ভবনই নয় জরুরী সেবা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও যেন ভূমিকম্পের কম্পন সহ্য করে টিকে থাকতে পারে সেদিকে নজর দেয়া উচিত।

৪. দীর্ঘমেয়াদী খরচ সাশ্রয়

 ভূমিকম্প সহায়ক ভবন নির্মাণের খরচ হয়ত সাধারন ভবন নির্মানের চেয়ে বেশি হতে পারে। তবে এই খরচটা দীর্ঘমেয়াদী খরচ সাশ্রয়ের কাজ করবে। ভূমিকম্প পরবর্তী যে ধংসাত্বক পরিস্থিতি তৈরি হয় তা পুনরায় নির্মান করতে যে সময় ও খরচটা লাগে তার চেয়ে অনেক কমেই প্রথমেই ভূমিকম্প সহায়ক ভবন নির্মান করা সম্ভব। ভবন নির্মানের সময় অভিজ্ঞ প্রকৌশলীর দ্বারা উচ্চ মাত্রার কম্পন সহায়ক স্ট্রাকচার ডিজাইন করিয়ে নেয়া উচিত।

৫. স্থিতিস্থাপকতা ও টেকশই উন্নয়ন

ভূমিকম্প সহায়ক ভবন নির্মান মানেই হল স্থিতিস্থাপক ও টেকশই উন্নয়ন। যেটা নিরাপত্তা প্রদানের পাশাপাশী উন্নয়নকে টেকশই করে। এই উদ্দেশ্য সরকার কতৃক আরোপিত ভবন নির্মানের সকল বিধিনিষেধ পরিপূর্নভাবে মেনে চলতে বাধ্যতামূলক করা উচিত। কেননা এই নিয়মগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে ভবন নির্মান করলে তা যথেষ্ট শক্তিশালী হবে এবং উচ্চমাত্রার কম্পন সহ্য করে টিকে থাকতে পারবে।

কীভাবে ভূমিকম্প সহায়ক ভবন নির্মাণ করা যায়?

ভূমিকম্প সহায়ক ভবন নির্মাণ করা কেন গুরুত্বপূর্ন তা আমরা জেনেছি। এখন চলুন দেখি কীভাবে তা তৈরি করা যেতে পারে।

১. মজবুত ফাউন্ডেশন দিন

একটি ভবন কতটা মজবুত এবং শক্তিশালী হবে তার সিংহ ভাগ নির্ভর করে এর ফাউন্ডেশনের উপর। তাই ভবন নির্মানের আগেই ভূমিকম্পনের কথা মাথায় রেখে প্রকৌশলীর কাছ থেকে ডিজাইন ও নির্মান কৌশল জেনে নিতে হবে।

২. মজবুত নির্মান কাঠামো

ভবনকে যে উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প হতে রক্ষার জন্য শূধুমাত্র মজবুত ফাউন্ডেশন দিলেই হবে না সাথে এর নির্মান কাঠামোও মজবুত করতে হবে। বহুতল বিশিষ্ট ভবনের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো আরো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত।

৩. শেয়ার ওয়াল ব্যবহার করুন

ভূমিকম্পের ধাক্কা থেকে ভবনকে নিরাপদ রাখতে শেয়ার ওয়াল ব্যবহার করা যেতে পারে। এই ওয়ালগুলো ভূমিকম্পের শকওয়েভ ট্র্যান্সফার করতে পারে। এই দেয়ালগুলো একাধিক প্যানেল দিয়ে তৈরি। তাই কম্পনের সময় ভবনের নিজস্ব আকার ধরে রাখতে সাহায্য করে।

৪. ডায়াফ্রাম নির্মান করুন

ডায়াফ্রাম নির্মান হল ভবনের কেন্দ্রীয় নির্মান। ছাঁদ, ডেক সহ ভবনের সম্পূর্ন কাঠামো এর উপর নির্ভর করে। এটি মেঝের ও সামগ্রিক নির্মানের কাঠিন্য দূর করে নমনীয় রাখতে পারে। 

৫. মোমেন্ট রেসিস্টিং ফ্রেম

এটি মূলত ভবন তৈরির একটি ডিজাইনের নাম। এই ডিজাইনে ভবন নির্মান করা হলে তা ভূমিকম্প থেকে আসা শকওয়েভ প্রতিরোধ করে বেশ ভালোভাবেই টিকে থকতে সক্ষম হবে। এই ডিজাইনে ভবন নির্মানের সময় অতিরিক্ত কিছু প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয় যা পরে ভবন সুরক্ষায় কাজে আসে।

ইতিকথা

আগের বছরগুলোতে সংঘটিত হওয়া বড় বড় দর্যোগগুলোর বিচার বিশ্লেষন করলে ভূমিকম্প সহায়ক ভবন নির্মানের গূরুত্ব সহজেই অনুধাবন করা যায়। আর ভূমিকম্প প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োজন মজবুত ফাউন্ডেশন ও মজবুত কাঠামো নির্মানের।

এছাড়াও মাটির প্রকৃতি, নির্মান সামগ্রীর কোয়ালিটি ইত্যাদিও বিবেচনায় রাখতে হবে। আধুনিক নির্মানের যে ডিজাইন রয়েছে যেমন মোমেন্ট রেসিস্টিং ফ্রেম ইত্যাদি নির্মান প্রকৌশলীর সাথে পরামর্শ না করেই করা উচিত নয়। আপনার ও আপনার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার লক্ষ্যে ভূমিকম্প সহ্য করতে সক্ষম এমন ভবন নিজে নির্মান করুন ও অন্যদেরও করতে উতাসাহিত করুন।

Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments